কত ভরি স্বর্ণ থাকলে যাকাত ফরজ? যাকাত নিয়ে বিস্তারিত

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে যাকাত অন্যতম। এটি কেবল একটি আর্থিক ইবাদত নয়, বরং এটি সামাজিক ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক ভারসাম্য এবং মুসলিম উম্মাহর পারস্পরিক সহযোগিতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। যাকাত আরবি শব্দ, যার আভিধানিক অর্থ বৃদ্ধি, পবিত্রতা, বরকত ও পরিশুদ্ধি। শরীয়তের পরিভাষায়, আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক নির্ধারিত নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে, তার একটি নির্দিষ্ট অংশ বছরান্তে দরিদ্র ও অভাবী মানুষের মধ্যে বিতরণ করাকে যাকাত বলে। যাকাত প্রদানের মাধ্যমে সম্পদ পবিত্র হয়, বৃদ্ধি পায় এবং সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস পায়।

image 1

ইসলামে যাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বহু স্থানে সালাতের পাশাপাশি যাকাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। এটি ধনীদের উপর আরোপিত একটি অবশ্যপালনীয় কর্তব্য, যা দরিদ্রদের অধিকার নিশ্চিত করে। যাকাত আদায় না করলে দুনিয়া ও আখিরাতে কঠিন শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে।

বিভিন্ন প্রকার সম্পদের উপর যাকাত ফরজ হয়, যেমন – স্বর্ণ, রৌপ্য, নগদ অর্থ, ব্যবসায়িক পণ্য, কৃষি ফসল এবং গৃহপালিত পশু। এই প্রবন্ধের মূল আলোচ্য বিষয় হলো স্বর্ণের যাকাত। আধুনিক যুগে স্বর্ণ একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এর মালিকানা অনেকেরই থাকে। তাই স্বর্ণের যাকাতের বিধান, নিসাব, হিসাব পদ্ধতি এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য অপরিহার্য। এই প্রবন্ধে আমরা স্বর্ণের যাকাতের বিস্তারিত বিধান নিয়ে আলোচনা করব, যাতে পাঠকগণ সহজেই তাদের উপর অর্পিত এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতটি সঠিকভাবে আদায় করতে পারেন।

যাকাতের নিসাব : কত ভরি স্বর্ণে যাকাত ফরজ?

যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য সম্পদের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ থাকতে হয়, যাকে ‘নিসাব’ বলা হয়। নিসাব হলো সেই সর্বনিম্ন পরিমাণ সম্পদ, যা থাকলে একজন মুসলিমের উপর যাকাত ফরজ হয়। স্বর্ণের ক্ষেত্রে নিসাবের পরিমাণ নিয়ে বিভিন্ন হাদিস ও ফিকহি মত প্রচলিত আছে, তবে অধিকাংশ আলেম ও ফিকাহবিদদের মতে, স্বর্ণের নিসাব হলো ৭.৫ ভরি (সাড়ে সাত ভরি) বা ৮৫ গ্রাম খাঁটি স্বর্ণ।

ঐতিহাসিকভাবে, স্বর্ণের নিসাব বিশ দিনার বা ২০০ দিরহাম রৌপ্যের সমমূল্য হিসেবে নির্ধারিত ছিল। আধুনিক পরিমাপে, বিশ দিনার স্বর্ণের ওজন প্রায় ৮৫ গ্রাম হয়। অন্যদিকে, সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণের ওজন প্রায় ৮৭.৪৮ গ্রাম বা ৯৫.৭৪৮ গ্রাম (বিভিন্ন মত অনুযায়ী) হয়ে থাকে। তবে, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ এবং অধিকাংশ ইসলামী স্কলারদের মতে, ৮৫ গ্রাম স্বর্ণকেই নিসাব হিসেবে ধরা হয়। যদি কারো মালিকানায় এই পরিমাণ বা তার বেশি স্বর্ণ থাকে এবং তা এক হিজরী বছর (চন্দ্র বছর) পূর্ণ হয়, তবে তার উপর যাকাত ফরজ হবে। এখানে ক্যারেট কোনো বিষয় নয়, বরং মোট খাঁটি স্বর্ণের পরিমাণই বিবেচ্য।

উদাহরণস্বরূপ, যদি কারো কাছে ২২ ক্যারেটের ১০ ভরি স্বর্ণ থাকে, তবে তাকে প্রথমে এর খাঁটি স্বর্ণের পরিমাণ বের করতে হবে। ১০ ভরি ২২ ক্যারেট স্বর্ণের খাঁটি অংশ হবে (১০ * ২২) / ২৪ = ৯.১৬ ভরি প্রায়। যেহেতু ৯.১৬ ভরি সাড়ে সাত ভরির বেশি, তাই তার উপর যাকাত ফরজ হবে।

উল্লেখ্য, স্বর্ণ যদি অলংকার হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তবে সে ক্ষেত্রে যাকাত প্রযোজ্য হবে কিনা, তা নিয়ে ফিকাহবিদদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তবে অধিকাংশের মতে, ব্যবহৃত অলংকারের উপরও যাকাত ফরজ, যদি তা নিসাব পরিমাণ হয় এবং এক বছর অতিবাহিত হয়।

যাকাতের পরিমাণ ও হিসাব পদ্ধতি

স্বর্ণের উপর যাকাতের হার সুনির্দিষ্ট। নিসাব পরিমাণ স্বর্ণের মালিক হলে, তার মোট মূল্যের ২.৫% বা ৪০ ভাগের ১ ভাগ যাকাত হিসেবে আদায় করতে হয়। এই হার স্বর্ণ ও রৌপ্য উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যাকাত আদায়ের সময় স্বর্ণের বর্তমান বাজারমূল্যকে ভিত্তি করে হিসাব করতে হবে, ক্রয়মূল্যকে নয়। অর্থাৎ, যেদিন যাকাত আদায় করা হবে, সেদিন প্রতি ভরি স্বর্ণের যে বাজারদর থাকবে, সেই অনুযায়ী মোট স্বর্ণের মূল্য নির্ধারণ করে তার ২.৫% প্রদান করতে হবে।

হিসাব পদ্ধতিকে সহজভাবে বোঝার জন্য একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে:

ধরা যাক, আপনার কাছে ১০ ভরি স্বর্ণ আছে এবং তা এক বছর ধরে আপনার মালিকানায় রয়েছে। বর্তমান বাজারমূল্য অনুযায়ী প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ১,০০,০০০ টাকা।

•মোট স্বর্ণের পরিমাণ: ১০ ভরি

•প্রতি ভরি স্বর্ণের বর্তমান বাজারমূল্য: ১,০০,০০০ টাকা

•মোট স্বর্ণের বর্তমান বাজারমূল্য: ১০ ভরি × ১,০০,০০০ টাকা/ভরি = ১০,০০,০০০ টাকা

•যাকাতের হার: ২.৫%

•যাকাতের পরিমাণ: ১০,০০,০০০ টাকা × ২.৫% = ২৫,০০০ টাকা

সুতরাং, এই ক্ষেত্রে আপনাকে ২৫,০০০ টাকা যাকাত হিসেবে আদায় করতে হবে। যদি আপনি স্বর্ণের পরিবর্তে স্বর্ণই যাকাত হিসেবে দিতে চান, তবে মোট স্বর্ণের ২.৫% অর্থাৎ ১০ ভরির ২.৫% = ০.২৫ ভরি স্বর্ণ যাকাত হিসেবে দিতে হবে।

যদি কারো কাছে বিভিন্ন ক্যারেটের স্বর্ণ থাকে, তবে সে ক্ষেত্রে প্রথমে সব স্বর্ণকে ২৪ ক্যারেটের সমতুল্য খাঁটি স্বর্ণে রূপান্তরিত করে মোট পরিমাণ বের করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কারো কাছে ১৮ ক্যারেটের ৫ ভরি এবং ২২ ক্যারেটের ৫ ভরি স্বর্ণ থাকে, তবে:

•১৮ ক্যারেটের ৫ ভরি স্বর্ণ = (৫ × ১৮) / ২৪ = ৩.৭৫ ভরি ২৪ ক্যারেট স্বর্ণ

•২২ ক্যারেটের ৫ ভরি স্বর্ণ = (৫ × ২২) / ২৪ = ৪.৫৮ ভরি ২৪ ক্যারেট স্বর্ণ

•মোট খাঁটি স্বর্ণ = ৩.৭৫ + ৪.৫৮ = ৮.৩৩ ভরি

যেহেতু ৮.৩৩ ভরি স্বর্ণ নিসাব পরিমাণ (৭.৫ ভরি) অতিক্রম করেছে, তাই এর উপর যাকাত ফরজ হবে। এরপর এই ৮.৩৩ ভরি স্বর্ণের বর্তমান বাজারমূল্য বের করে তার ২.৫% যাকাত হিসেবে দিতে হবে।

যাকাত হিসাব করার সময় স্বর্ণের সাথে যদি নগদ অর্থ, রৌপ্য বা ব্যবসায়িক পণ্য থাকে, তবে সেগুলোর মূল্যও যোগ করে মোট সম্পদের উপর যাকাত হিসাব করা যেতে পারে, যদি সেগুলোর সম্মিলিত মূল্য রৌপ্যের নিসাব (৫২.৫ ভরি বা প্রায় ৬৭০ গ্রাম রৌপ্যের মূল্য) পরিমাণ হয়। তবে স্বর্ণের নিসাব পূরণ হলে শুধু স্বর্ণের উপর যাকাত দিলেই হবে।

যাকাত ফরজ হওয়ার শর্তাবলী

স্বর্ণের উপর যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য কিছু নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ হওয়া আবশ্যক। এই শর্তগুলো পূরণ না হলে যাকাত ফরজ হয় না। শর্তগুলো নিম্নরূপ:

১. নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা: যাকাত ফরজ হওয়ার প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো, ব্যক্তির মালিকানায় নিসাব পরিমাণ স্বর্ণ থাকা। স্বর্ণের ক্ষেত্রে এই নিসাব হলো ৭.৫ ভরি বা ৮৫ গ্রাম খাঁটি স্বর্ণ। যদি কারো কাছে এই পরিমাণ স্বর্ণ না থাকে, তবে তার উপর স্বর্ণের যাকাত ফরজ হবে না।

২. সম্পদের উপর এক বছর পূর্ণ হওয়া (হাওলানুল হাওল): নিসাব পরিমাণ স্বর্ণের মালিক হওয়ার পর সেই স্বর্ণের উপর এক পূর্ণ হিজরী বছর (চন্দ্র বছর) অতিবাহিত হতে হবে। অর্থাৎ, যদি কোনো ব্যক্তি ১লা রমজান নিসাব পরিমাণ স্বর্ণের মালিক হন, তবে পরবর্তী ১লা রমজান পর্যন্ত সেই স্বর্ণ তার মালিকানায় থাকতে হবে। এই এক বছর সময়ের মধ্যে যদি স্বর্ণের পরিমাণ নিসাবের নিচে নেমে যায়, তবে যাকাত ফরজ হবে না। তবে, যদি নিসাবের নিচে নেমে যাওয়ার পর আবার নিসাব পরিমাণ হয়ে যায় এবং বছরের শেষ পর্যন্ত নিসাব পরিমাণ থাকে, তবে বছর পূর্তিতে যাকাত ফরজ হবে।

৩. সম্পদের পূর্ণ মালিকানা: যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য সম্পদের উপর ব্যক্তির পূর্ণ মালিকানা থাকতে হবে। অর্থাৎ, সম্পদটি তার নিজস্ব সম্পত্তি হতে হবে এবং এর উপর তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। বন্ধক রাখা স্বর্ণ বা অন্যের মালিকানাধীন স্বর্ণের উপর যাকাত ফরজ হয় না।

৪. ঋণমুক্ত থাকা: যদি কোনো ব্যক্তির নিসাব পরিমাণ স্বর্ণ থাকে, কিন্তু তার উপর এমন ঋণ থাকে যা পরিশোধ করলে তার স্বর্ণের পরিমাণ নিসাবের নিচে নেমে যায়, তবে তার উপর যাকাত ফরজ হবে না। তবে, যদি ঋণ পরিশোধের পরও নিসাব পরিমাণ স্বর্ণ অবশিষ্ট থাকে, তবে অবশিষ্ট স্বর্ণের উপর যাকাত ফরজ হবে। এখানে ব্যক্তিগত ঋণের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবসায়িক ঋণের ক্ষেত্রে ভিন্ন বিধান প্রযোজ্য হতে পারে।

৫. সম্পদ উৎপাদনশীল হওয়া (যদি প্রযোজ্য হয়): যদিও স্বর্ণ সাধারণত উৎপাদনশীল সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয় না, তবে যদি স্বর্ণকে বিনিয়োগ বা ব্যবসার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়, তবে তা উৎপাদনশীল সম্পদের অন্তর্ভুক্ত হবে। তবে, অলংকার হিসেবে ব্যবহৃত স্বর্ণের ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতার শর্ত প্রযোজ্য নয়, বরং নিসাব ও হাওলানুল হাওলই প্রধান শর্ত।

এই শর্তগুলো পূরণ হলেই একজন মুসলিমের উপর স্বর্ণের যাকাত ফরজ হয় এবং তাকে তা আদায় করতে হয়।

কোন ধরনের স্বর্ণে যাকাত প্রযোজ্য?

স্বর্ণের যাকাত প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, কোন ধরনের স্বর্ণের উপর যাকাত প্রযোজ্য হবে? ইসলামি শরীয়ত অনুযায়ী, সকল প্রকার স্বর্ণের উপর যাকাত ফরজ, যদি তা নিসাব পরিমাণ হয় এবং অন্যান্য শর্ত পূরণ করে। এর মধ্যে রয়েছে:

•স্বর্ণের বার বা পিন্ড: যে স্বর্ণ অলংকার হিসেবে ব্যবহৃত হয় না, বরং বার বা পিন্ড আকারে থাকে, তার উপর যাকাত ফরজ। এটি সাধারণত বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে রাখা হয়।

•স্বর্ণমুদ্রা: স্বর্ণের তৈরি মুদ্রা, যা লেনদেনের জন্য ব্যবহৃত হয় বা সঞ্চয় হিসেবে রাখা হয়, তার উপরও যাকাত ফরজ।

•স্বর্ণালংকার: এটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয়। মহিলারা যে স্বর্ণালংকার ব্যবহার করেন, তার উপর যাকাত ফরজ হবে কিনা, এ নিয়ে ফিকাহবিদদের মধ্যে দুটি প্রধান মত রয়েছে।

•প্রথম মত (অধিকাংশ ফিকাহবিদ): অধিকাংশ ফিকাহবিদ এবং মাযহাবের (যেমন হানাফী, শাফেয়ী, হাম্বলী) মতে, ব্যবহৃত হোক বা না হোক, নিসাব পরিমাণ স্বর্ণালংকারের উপর যাকাত ফরজ। তাদের যুক্তি হলো, হাদিসে স্বর্ণের উপর যাকাত ফরজ হওয়ার কথা বলা হয়েছে এবং সেখানে ব্যবহৃত বা অব্যবহৃতের কোনো পার্থক্য করা হয়নি। সম্পদ যে রূপেই থাকুক না কেন, যদি তা নিসাব পরিমাণ হয় এবং এক বছর অতিবাহিত হয়, তবে তার উপর যাকাত ফরজ হবে। এটি সম্পদকে বৃদ্ধি ও পবিত্র করার একটি উপায়।

•দ্বিতীয় মত (কিছু ফিকাহবিদ): কিছু ফিকাহবিদ (যেমন ইমাম মালিকের একটি মত এবং কিছু সমসাময়িক আলেম) মনে করেন যে, যদি স্বর্ণালংকার ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য হয় এবং তা অপচয় বা অহংকারের উদ্দেশ্যে না হয়, তবে তার উপর যাকাত ফরজ নয়। তাদের যুক্তি হলো, ব্যক্তিগত ব্যবহারের জিনিসপত্রের উপর যাকাত ফরজ হয় না, যেমন – পোশাক, আসবাবপত্র ইত্যাদি। তবে, যদি তা প্রয়োজনের অতিরিক্ত হয় বা বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে রাখা হয়, তবে যাকাত ফরজ হবে।

যাকাত হিসাব করার সময় স্বর্ণের ক্যারেট একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেহেতু যাকাত খাঁটি স্বর্ণের উপর ফরজ হয়, তাই বিভিন্ন ক্যারেটের স্বর্ণের ক্ষেত্রে সেগুলোকে ২৪ ক্যারেটের সমতুল্য খাঁটি স্বর্ণে রূপান্তরিত করে হিসাব করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, ২২ ক্যারেটের স্বর্ণে ৯১.৬৭% খাঁটি স্বর্ণ থাকে, ২১ ক্যারেটে ৮৭.৫% এবং ১৮ ক্যারেটে ৭৫% খাঁটি স্বর্ণ থাকে। এই অনুপাত অনুযায়ী মোট খাঁটি স্বর্ণের পরিমাণ বের করে তার উপর যাকাত হিসাব করতে হবে।

যাকাত আদায়ের সময় ও পদ্ধতি

যাকাত আদায়ের সময় এবং পদ্ধতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন, যাতে এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতটি সঠিকভাবে সম্পন্ন করা যায়।

যাকাত আদায়ের সময়:

স্বর্ণের যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য সম্পদের উপর এক হিজরী বছর (চন্দ্র বছর) পূর্ণ হওয়া আবশ্যক। এই এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর যখনই সম্ভব হয়, তখনই যাকাত আদায় করে ফেলা উচিত। যাকাত আদায়ে বিলম্ব করা উচিত নয়, কারণ এটি আল্লাহ তায়ালার হক এবং দরিদ্রদের অধিকার। অনেকে রমজান মাসকে যাকাত আদায়ের জন্য বেছে নেন, কারণ এই মাসে ইবাদতের সওয়াব বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। তবে, রমজান মাসেই যাকাত আদায় করতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যখনই আপনার সম্পদের উপর এক বছর পূর্ণ হবে, তখনই যাকাত আদায় করা ফরজ হয়ে যাবে।

যদি কোনো ব্যক্তি বছরের মাঝামাঝি সময়ে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হন, তবে তাকে সেই দিন থেকে এক বছর গণনা শুরু করতে হবে। পরবর্তী বছর ঠিক একই তারিখে তার উপর যাকাত ফরজ হবে। যদি তিনি বছরের মধ্যে আরও সম্পদ অর্জন করেন, তবে সেই নতুন সম্পদের জন্য আলাদাভাবে বছর গণনা করার প্রয়োজন নেই, বরং মূল নিসাবের সাথে যোগ করে বছর পূর্তিতে যাকাত আদায় করা যাবে।

যাকাত আদায়ের পদ্ধতি:

যাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে মূলত দুটি পদ্ধতি প্রচলিত আছে:

১. নগদ টাকা বা সমমূল্যের বস্তু দ্বারা যাকাত আদায়: এটি সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি। যাকাত ফরজ হওয়া স্বর্ণের বর্তমান বাজারমূল্য নির্ধারণ করে তার ২.৫% নগদ টাকা হিসেবে দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করা। উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনার স্বর্ণের মোট মূল্য ১০ লক্ষ টাকা হয়, তবে আপনাকে ২৫,০০০ টাকা নগদ যাকাত দিতে হবে। এই টাকা সরাসরি দরিদ্র, অভাবী, মিসকিন, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি বা যাকাত গ্রহণের যোগ্য অন্য কাউকে দেওয়া যেতে পারে।

২. স্বর্ণ দ্বারা যাকাত আদায়: যদি কেউ চান, তবে তিনি স্বর্ণের পরিবর্তে স্বর্ণই যাকাত হিসেবে দিতে পারেন। এক্ষেত্রে, মোট স্বর্ণের ২.৫% স্বর্ণ যাকাত হিসেবে দিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনার কাছে ১০ ভরি স্বর্ণ থাকে, তবে আপনাকে ০.২৫ ভরি (সাড়ে চার আনা) স্বর্ণ যাকাত হিসেবে দিতে হবে। তবে, স্বর্ণের ছোট অংশ পরিমাপ করা এবং বিতরণ করা কঠিন হতে পারে, তাই নগদ টাকা হিসেবে যাকাত আদায় করা অধিকতর সহজ ও সুবিধাজনক।

যাকাত আদায়ের সময় নিয়ত করা জরুরি। অর্থাৎ, আপনি যে অর্থ বা বস্তু দিচ্ছেন, তা যাকাত হিসেবে দিচ্ছেন – এই নিয়ত মনে মনে থাকতে হবে। যাকে যাকাত দেওয়া হচ্ছে, তাকে জানানোর প্রয়োজন নেই যে এটি যাকাতের অর্থ।

যাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও সঠিক হিসাব রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি বছর যাকাত হিসাব করে তা সঠিকভাবে আদায় করা উচিত। প্রয়োজনে নির্ভরযোগ্য আলেম বা ইসলামী স্কলারদের সাথে পরামর্শ করে যাকাত আদায় করা যেতে পারে।

যাকাত কাদেরকে দেওয়া যাবে?

যাকাত কেবল নির্দিষ্ট কিছু শ্রেণীর মানুষের জন্য নির্ধারিত। পবিত্র কোরআনে সূরা তাওবার ৬০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা যাকাত গ্রহণের আটটি খাত সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। এই আটটি খাত হলো:

১. ফকির (দরিদ্র): যাদের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের জন্য পর্যাপ্ত সম্পদ নেই।
২. মিসকিন (অভাবী): যারা ফকিরদের চেয়েও বেশি অভাবী এবং যাদের জীবনধারণের জন্য কোনো সম্পদ নেই।
৩. যাকাত আদায়কারী (আমিলুন আলাইহা): যারা যাকাত সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিতরণের কাজে নিয়োজিত। তাদের পারিশ্রমিক যাকাতের অর্থ থেকে দেওয়া যেতে পারে।
৪. নব-মুসলিম (মুয়াল্লাফাতুল কুলুব): যাদের মনকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য বা ইসলামে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য যাকাত দেওয়া হয়।
৫. দাস মুক্তির জন্য (ফির রিকাব): দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভের জন্য বা যুদ্ধবন্দীদের মুক্তির জন্য। আধুনিক যুগে এই খাতটি দাসপ্রথা বিলুপ্ত হওয়ায় কম প্রযোজ্য, তবে এর আওতায় ঋণগ্রস্তদের মুক্তিও আসতে পারে।
৬. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি (আল-গারিমুন): যারা বৈধ কারণে ঋণগ্রস্ত এবং ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য নেই। ৭. আল্লাহর পথে ব্যয়কারী (ফি সাবিলিল্লাহ): যারা আল্লাহর পথে জিহাদ বা ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের জন্য সংগ্রাম করছেন এবং যাদের আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন। এর মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা দাওয়াতের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরাও অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন।
৮. মুসাফির (ইবনুস সাবিল): যারা সফরে গিয়ে অর্থকষ্টে পড়েছেন, যদিও নিজ বাড়িতে তাদের সম্পদ থাকতে পারে।

এই আটটি শ্রেণীর বাইরে অন্য কাউকে যাকাত দেওয়া জায়েজ নয়। যাকাত প্রদানের সময় এই খাতগুলো সম্পর্কে জ্ঞান থাকা এবং সঠিকভাবে বিতরণ করা অত্যন্ত জরুরি। নিজের আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে যারা এই আটটি শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত, তাদেরকে যাকাত দেওয়া অধিক সওয়াবের কাজ। তবে, নিজের পিতা-মাতা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, সন্তান-সন্ততি এবং স্বামী-স্ত্রীকে যাকাত দেওয়া জায়েজ নয়, কারণ তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব এমনিতেই ব্যক্তির উপর বর্তায়।

যাকাত না দেওয়ার পরিণতি

যাকাত ইসলামের একটি অপরিহার্য স্তম্ভ এবং এটি আদায় করা প্রত্যেক নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকের উপর ফরজ। যাকাত আদায় না করার পরিণতি দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতেই অত্যন্ত ভয়াবহ। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে এ বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে।

দুনিয়াতে পরিণতি:

সম্পদে বরকত হ্রাস: যাকাত আদায় না করলে সম্পদ থেকে বরকত উঠে যায়। বাহ্যিকভাবে সম্পদ বৃদ্ধি পেলেও তাতে কোনো কল্যাণ থাকে না এবং তা বিভিন্ন বিপদাপদের কারণ হতে পারে।

অর্থনৈতিক অস্থিরতা: যাকাত ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য হলো সমাজে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা। যাকাত আদায় না হলে সমাজে ধনী-গরিবের বৈষম্য বৃদ্ধি পায়, যা অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।

আল্লাহর অসন্তুষ্টি: যাকাত আদায় না করা আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করার শামিল, যা আল্লাহর অসন্তুষ্টির কারণ হয়।

আখিরাতে পরিণতি:

আখিরাতে যাকাত আদায় না করার পরিণতি আরও ভয়াবহ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন:

“আর যারা সোনা ও রূপা জমা করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তির সুসংবাদ দাও। যেদিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে, অতঃপর তা দ্বারা তাদের কপাল, পার্শ্বদেশ ও পিঠকে দাগানো হবে (এবং বলা হবে), ‘এটাই তোমাদের সেই সম্পদ যা তোমরা নিজেদের জন্য জমা করে রেখেছিলে। সুতরাং তোমরা যা জমা করেছিলে তার স্বাদ গ্রহণ করো।” (সূরা তাওবা: ৩৪-৩৫)

এই আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, যারা যাকাত আদায় করে না, তাদের জন্য আখিরাতে কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে। হাদিস শরীফেও এ বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

“যাকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন, কিন্তু সে তার যাকাত আদায় করেনি, কিয়ামতের দিন তার সম্পদকে একটি বিষধর সাপের রূপ দেওয়া হবে, যার দুটি চোখ থাকবে এবং তা তার গলায় পেঁচিয়ে যাবে। অতঃপর সাপটি তার উভয় চোয়ালে দংশন করতে থাকবে এবং বলবে, ‘আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার সঞ্চিত ধন।” (বুখারী)

এই হাদিস দ্বারা যাকাত আদায় না করার ভয়াবহতা স্পষ্ট হয়। যাকাত আদায় না করা কেবল একটি আর্থিক অপরাধ নয়, বরং এটি একটি গুরুতর পাপ, যার জন্য ব্যক্তিকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তাই প্রত্যেক মুসলিমের উচিত, তার সম্পদের সঠিক হিসাব রেখে সময়মতো যাকাত আদায় করা এবং এই ভয়াবহ পরিণতি থেকে নিজেকে রক্ষা করা। যাকাত আদায়ের মাধ্যমে সম্পদ পবিত্র হয়, বৃদ্ধি পায় এবং দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ লাভ হয়।

আরও পড়ুন: আজকের সোনার দাম কত | ২২, ২১ ও ১৮ ক্যারেট | Gold Price in Bangladesh (১৫ জুলাই ২০২৫)

উপসংহার

যাকাত ইসলামের একটি মৌলিক স্তম্ভ এবং মুসলিম সমাজের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কল্যাণের জন্য অপরিহার্য একটি বিধান। স্বর্ণের যাকাত, অন্যান্য সম্পদের যাকাতের মতোই, ধনীদের উপর আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আরোপিত একটি পবিত্র দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে একদিকে যেমন সম্পদের পবিত্রতা ও বরকত বৃদ্ধি পায়, তেমনি অন্যদিকে দরিদ্র ও অভাবী মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হয় এবং সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস পায়।

আমরা এই প্রবন্ধে স্বর্ণের যাকাতের নিসাব, হিসাব পদ্ধতি, যাকাত ফরজ হওয়ার শর্তাবলী, কোন ধরনের স্বর্ণে যাকাত প্রযোজ্য এবং যাকাত আদায়ের সময় ও পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এছাড়াও, যাকাত কাদেরকে দেওয়া যাবে এবং যাকাত আদায় না করার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কেও আলোকপাত করা হয়েছে।

প্রত্যেক মুসলিমের উচিত, তার সম্পদের সঠিক হিসাব রাখা এবং সময়মতো যাকাত আদায় করা। যাকাত আদায়ে কোনো প্রকার অবহেলা বা গড়িমসি করা উচিত নয়, কারণ এটি কেবল আল্লাহর নির্দেশই নয়, বরং দরিদ্রদের প্রতি আমাদের নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্বও বটে। যাকাত আদায়ের মাধ্যমে আমরা দুনিয়াতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি এবং আখিরাতে কঠিন শাস্তি থেকে মুক্তি পেতে পারি। আসুন, আমরা সবাই যাকাতের গুরুত্ব উপলব্ধি করি এবং সঠিকভাবে তা আদায় করে একটি সুষম ও কল্যাণকর সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সঠিকভাবে যাকাত আদায় করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

আমি নাইমা চৌধুরী একজন অভিজ্ঞ স্বর্ণ বিশেষজ্ঞ এবং স্বর্ণ সম্পর্কিত তথ্য ও বিশ্লেষণে পারদর্শী। আমি GoldBD বাংলা ব্লগে প্রধান লেখক হিসেবে কাজ করছি, স্বর্ণের বাজারদর, বিনিয়োগ পরামর্শ, এবং স্বর্ণ সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখালেখি করছি নিয়মিত। আমার লেখাগুলো সহজ ও তথ্যবহুল, যা পাঠকদের স্বর্ণ সম্পর্কে আরও ভালোভাবে বুঝতে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে।

Leave a Comment