সোনা পরিমাপের সনাতনি পদ্ধতি: ইতিহাস ও প্রচলন

সোনা পৃথিবীর প্রাচীনতম মূল্যবান ধাতুগুলোর মধ্যে একটি। এর ব্যবহার ও মূল্য নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন পরিমাপ পদ্ধতি গৃহীত হয়েছে। আধুনিক ওজন পরিমাপের ইউনিট যেমন গ্রাম, কিলোগ্রাম ইত্যাদি চালু হওয়ার আগে, সনাতনি পদ্ধতিতেই সোনার পরিমাণ নির্ধারিত হতো। এই নিবন্ধে আমরা সোনা পরিমাপের সনাতনি পদ্ধতি, এর ইতিহাস এবং প্রচলন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।

সোনা পরিমাপের ইতিহাস

image

সোনা পরিমাপের ইতিহাস প্রায় ৫,০০০ বছর পূর্বে মেসোপটেমিয়া ও প্রাচীন মিশরের সময়কাল থেকে শুরু হয়। সেই সময় সোনা মূলত বার বা মুদ্রার আকারে লেনদেন হতো। তবে এর মান ও পরিমাপ নির্ধারণে নির্দিষ্ট কিছু একক ব্যবহৃত হতো। প্রাচীন যুগে বিভিন্ন সভ্যতায় সোনা পরিমাপের জন্য আলাদা পদ্ধতি চালু ছিল।

  • মিশরীয় সভ্যতা: মিশরে সোনা ওজন করার জন্য “দেবেন” নামক একটি একক ব্যবহৃত হতো।
  • গ্রিক সভ্যতা: গ্রিসে ‘ড্রাকমা’ এবং ‘ট্যালেন্ট’ নামক একক ব্যবহৃত হতো।
  • রোমান সাম্রাজ্য: রোমানরা ‘অউরিয়াস’ নামে একটি বিশেষ সোনার মুদ্রা প্রচলিত করেছিল, যার মান নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনার ওজনের উপর নির্ভর করত।
  • ভারতীয় উপমহাদেশ: ভারতে সোনা পরিমাপের জন্য ‘রত্ন’, ‘তোলা’, ‘মাসা’ ইত্যাদি একক ব্যবহৃত হতো।

ভারত ও বাংলার সনাতনি সোনা পরিমাপ পদ্ধতি

ভারতীয় উপমহাদেশে সোনা পরিমাপের জন্য বেশ কয়েকটি বিশেষ একক প্রচলিত ছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিচে দেওয়া হলো:

১. রত্ন (Ratti)

রত্ন হলো ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী ওজন পরিমাপের একটি একক, যা প্রাচীনকালে সোনা ও মূল্যবান রত্নের পরিমাণ নির্ধারণের জন্য ব্যবহৃত হতো। সাধারণত ১ রত্ন = ০.১২ গ্রাম সোনা।

২. মাসা (Masha)

মাসা হলো ভারতীয় পরিমাপের আরেকটি একক। ১ মাসা সাধারণত ০.৯৭ গ্রাম সোনার সমান।

৩. আনা (Aana)

আনা ব্যবহৃত হতো মুদ্রার পরিমাপের ক্ষেত্রে। ১ আনা = ১.৪৬ গ্রাম সোনা।

৪. তোলা (Tola)

তোলা হলো ভারতীয় উপমহাদেশে সোনা পরিমাপের অন্যতম জনপ্রিয় একক। ১ তোলা সাধারণত ১১.৬৬ গ্রাম সোনার সমান ধরা হয়।

৫. সের (Ser)

বৃহৎ পরিমাণ সোনা পরিমাপের জন্য ‘সের’ ব্যবহার করা হতো। ১ সের = ৮০ তোলা।

আধুনিক ও ঐতিহ্যবাহী সোনার পরিমাপের তুলনা

বর্তমানে গ্রাম এবং কিলোগ্রাম পদ্ধতি বিশ্বব্যাপী সোনা পরিমাপের জন্য গৃহীত হয়েছে। তবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এখনো ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি আংশিকভাবে প্রচলিত। নিচে একটি তুলনামূলক ছক দেওয়া হলো:

ঐতিহ্যবাহী এককসমতুল্য গ্রাম
১ রত্ন০.১২ গ্রাম
১ মাসা০.৯৭ গ্রাম
১ আনা১.৪৬ গ্রাম
১ তোলা১১.৬৬ গ্রাম
১ সের৯৩৩.২ গ্রাম

সনাতনি পরিমাপ পদ্ধতির প্রচলন

আজকের দিনে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে অত্যন্ত নির্ভুলভাবে সোনা পরিমাপ করা সম্ভব হলেও, কিছু ক্ষেত্রে সনাতনি পদ্ধতি এখনো ব্যবহৃত হয়।

১. স্বর্ণকার ও স্বর্ণ ব্যবসায়ী

ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে ছোট স্বর্ণকার এবং ব্যবসায়ীরা এখনো ‘তোলা’ পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকেন।

২. পারিবারিক ঐতিহ্য

বাঙালি ও ভারতীয় উপমহাদেশের অনেক পরিবারে এখনো সোনা পরিমাপের সময় ‘তোলা’ ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে।

৩. উৎসব ও বিবাহ

বিশেষ করে বিয়ের সময়ে বর-কনের জন্য সোনা পরিমাপের ক্ষেত্রে গ্রাম এককের পাশাপাশি ‘তোলা’ ব্যবহৃত হয়।

সোনা পরিমাপের কোন পদ্ধতি সবচেয়ে নির্ভুল?

সোনা পরিমাপের সবচেয়ে নির্ভুল পদ্ধতি হলো আধুনিক ডিজিটাল স্কেল এবং এক্স-রে XRF বিশ্লেষণ

১. ডিজিটাল স্কেল পদ্ধতি

এই পদ্ধতিতে উচ্চ-সংবেদনশীল ডিজিটাল ওজন মাপার যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, যা মিলিগ্রাম পর্যন্ত নির্ভুলভাবে সোনার ওজন নির্ধারণ করতে পারে। আধুনিক বাণিজ্যিক স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা সাধারণত এই পদ্ধতি ব্যবহার করেন।

২. ট্রয় আউন্স (Troy Ounce) পদ্ধতি

আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার পরিমাপের জন্য ট্রয় আউন্স ব্যবহার করা হয়, যা ৩১.১০৩৫ গ্রাম সমান। এই পদ্ধতি অত্যন্ত নির্ভুল এবং বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত।

৩. XRF বিশ্লেষণ

এই পদ্ধতিতে এক্স-রে প্রযুক্তি ব্যবহার করে সোনার বিশুদ্ধতা নির্ধারণ করা হয়, যা অত্যন্ত নির্ভুল এবং অ-ধ্বংসাত্মক (Non-destructive) পদ্ধতি। এটি বিশেষত ২৪ ক্যারেট, ২২ ক্যারেট, বা অন্যান্য খাদযুক্ত সোনার বিশুদ্ধতা নির্ণয়ে কার্যকর।

৪. হাইড্রোস্ট্যাটিক ওয়েটিং (Hydrostatic Weighing) পদ্ধতি

এই পদ্ধতিতে পানির নির্দিষ্ট ঘনত্বের সাথে তুলনা করে সোনার বিশুদ্ধতা নির্ধারণ করা হয়। এটি প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবহৃত হলেও বর্তমানে তুলনামূলক কম প্রচলিত।

যদি সবচেয়ে নির্ভুল পদ্ধতির কথা বলা হয়, তবে এক্স-রে ফ্লুরোসেন্স (XRF) বিশ্লেষণ এবং ডিজিটাল স্কেল পদ্ধতি আধুনিক ও নির্ভুল পরিমাপের জন্য সবচেয়ে কার্যকর। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ট্রয় আউন্স পদ্ধতি সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়, যা নির্ভরযোগ্য ও স্বীকৃত।

আরও পড়ুনঃ আজকের সোনার দাম কত | ২২, ২১ ও ১৮ ক্যারেট | Gold Price in Bangladesh

উপসংহার

সোনা পরিমাপের সনাতনি পদ্ধতি শত শত বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে এবং আজও এর প্রভাব বিদ্যমান। যদিও আধুনিক পরিমাপ পদ্ধতি সহজলভ্য হয়েছে, তবুও ঐতিহ্যগত কারণ ও স্বর্ণকারদের অভ্যাসগত প্রয়োগের ফলে সনাতনি পদ্ধতি এখনো আংশিকভাবে টিকে আছে। ভবিষ্যতে আধুনিক ও ঐতিহ্যবাহী পরিমাপ পদ্ধতির মধ্যে আরও সমন্বয় ঘটবে বলে আশা করা যায়।

আমি নাইমা চৌধুরী একজন অভিজ্ঞ স্বর্ণ বিশেষজ্ঞ এবং স্বর্ণ সম্পর্কিত তথ্য ও বিশ্লেষণে পারদর্শী। আমি GoldBD বাংলা ব্লগে প্রধান লেখক হিসেবে কাজ করছি, স্বর্ণের বাজারদর, বিনিয়োগ পরামর্শ, এবং স্বর্ণ সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখালেখি করছি নিয়মিত। আমার লেখাগুলো সহজ ও তথ্যবহুল, যা পাঠকদের স্বর্ণ সম্পর্কে আরও ভালোভাবে বুঝতে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে।

Leave a Comment