স্বর্ণ হলো মূল্যবান ধাতু যা যুগ যুগ ধরে গহনা, বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের উপর নির্ভরশীল এবং প্রতিদিনই এর মূল্য পরিবর্তিত হতে পারে। এই আর্টিকেলে আমরা বাংলাদেশে বর্তমান স্বর্ণের দাম, মূল্য নির্ধারণের প্রক্রিয়া, এবং স্বর্ণ কেনার সময় যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখা উচিত তা নিয়ে আলোচনা করব।
স্বর্ণ কি?

স্বর্ণ (Gold) হলো একটি মূল্যবান ধাতু, যার রাসায়নিক সংকেত Au এবং পারমাণবিক সংখ্যা ৭৯। এটি পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ও বহুল ব্যবহৃত ধাতু যা মূলত অলংকার, বিনিয়োগ এবং শিল্পকার্যে ব্যবহৃত হয়। স্বর্ণের উজ্জ্বল হলুদ রঙ ও চকচকে প্রকৃতি একে অত্যন্ত আকর্ষণীয় করে তুলেছে, যার কারণে এটি দীর্ঘকাল ধরে সৌন্দর্য ও সম্পদের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
বাংলাদেশে স্বর্ণের বর্তমান দাম (প্রতি ভরি)
স্বর্ণের দাম প্রতিদিন পরিবর্তিত হয় এবং এটি বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) নির্ধারণ করে। স্বর্ণের মূল্যের উপর প্রভাব ফেলে আন্তর্জাতিক বাজারের ওঠা-নামা, ডলারের মান, এবং দেশের আমদানি শুল্ক।
নিচের টেবিলে বাংলাদেশে আজকের প্রতি ভরি সোনার দাম দেওয়া হল। ২২ ক্যারেট, ২১ ক্যারেট, ১৮ ক্যারেট ও সনাতনী পদ্ধতিতে সোনার দামের লাইভ আপডেট প্রতি ভরি হিসাবে মুল্য দেওয়া হল।
সোনা | বিবরণ | মূল্য (প্রতি ভরি) |
---|---|---|
২২ ক্যারেট সোনা | ক্যাডমিয়াম (হলমার্ক সোনা) | ১৭২,৩৩৫.৬০ টাকা |
২১ ক্যারেট সোনা | ক্যাডমিয়াম (হলমার্ক সোনা) | ১৬৪,৪৯৭.৩৯ টাকা |
১৮ ক্যারেট সোনা | ক্যাডমিয়াম (হলমার্ক সোনা) | ১৪০,৯৯৪.৪৩ টাকা |
সনাতনি পদ্ধতি | প্রথাগত সোনা | ১১৬,৬৪০.০০ টাকা |
সুত্র: বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (BAJUS)
বিঃ দ্রঃ দামের এই তথ্য প্রতিদিন পরিবর্তিত হতে পারে, তাই স্বর্ণ কেনার আগে সঠিক দাম যাচাই করে করে আমাদের প্রতিদিনের সোনার দামের পোস্ট দেখে আসুন।
স্বর্ণের দাম কিভাবে নির্ধারণ হয়?
১. আন্তর্জাতিক বাজার: স্বর্ণের মূল্য বৈশ্বিক চাহিদা এবং সরবরাহের উপর নির্ভর করে।
২. মুদ্রার মান: ডলারের মান বৃদ্ধি পেলে স্বর্ণের দাম সাধারণত বৃদ্ধি পায়।
৩. দেশীয় চাহিদা: উৎসব মৌসুমে স্বর্ণের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এর দাম বাড়তে পারে।
স্বর্ণ কেনার সেরা সময় কখন?
অনেকে মনে করেন, স্বর্ণ কেনার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় থাকে যখন দাম তুলনামূলকভাবে কম থাকে। সাধারণত, নিম্নলিখিত সময়গুলোতে স্বর্ণ কেনার ভালো সুযোগ থাকে:
- বছরের শেষ প্রান্তিকে: সাধারণত বছরের শেষ দিকে আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের চাহিদা কম থাকে, ফলে দাম কিছুটা কমতে পারে।
- বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের সময়: যখন বাজারে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা থাকে, তখন বিনিয়োগকারীরা স্বর্ণের প্রতি ঝুঁকে পড়ে, ফলে স্বর্ণের দাম বাড়তে পারে বা কমতে পারে।
- উৎসবের আগে ও পরে: বাংলাদেশে ঈদ, দুর্গাপূজা, এবং বিয়ের মৌসুমে স্বর্ণের চাহিদা বেড়ে যায়, তাই দামও বাড়ে। উৎসবের পরে দাম কিছুটা হ্রাস পেতে পারে।
স্বর্ণ কেনার সময় যেসব বিষয় খেয়াল রাখবেন
১. বিশুদ্ধতা পরীক্ষা করুন: BIS হলমার্ক দেখে নিশ্চিত করুন স্বর্ণের বিশুদ্ধতা।
২. বর্তমান দাম যাচাই করুন: স্থানীয় জুয়েলারি দোকান এবং অনলাইন সোর্স থেকে দাম নিশ্চিত করুন।
৩. অতিরিক্ত চার্জ: মজুরি এবং ভ্যাটের মতো অতিরিক্ত চার্জ সম্পর্কে ধারণা রাখুন।
স্বর্ণ সংরক্ষণের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ
স্বর্ণ কেনার পর সেটি নিরাপদে সংরক্ষণ করা গুরুত্বপূর্ণ। কিছু পরামর্শ:
- ব্যাংকের লকার ব্যবহার করুন: উচ্চমূল্যের স্বর্ণ সংরক্ষণের জন্য ব্যাংকের লকার একটি নিরাপদ বিকল্প।
- বীমা করুন: স্বর্ণ চুরি বা ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেতে বীমা করানো যেতে পারে।
- নিজস্ব নিরাপদ ব্যবস্থা: বাড়িতে থাকলে নিরাপদ আলমারি বা লকার ব্যবহার করুন এবং কেউ যেন এর সম্পর্কে না জানে।
স্বর্ণ বিক্রির সময় করণীয়
স্বর্ণ বিক্রির সময় কিছু বিষয় খেয়াল রাখা জরুরি, যেমন:
- বাজারদর যাচাই করা: বিক্রির আগে প্রতিদিনের বাজারমূল্য সম্পর্কে জানা জরুরি।
- বিশুদ্ধতা পরীক্ষার রিপোর্ট রাখা: স্বর্ণের বিশুদ্ধতার সনদ বা হলমার্ক সনদ থাকলে ভালো দামে বিক্রি করা সহজ হবে।
- নিয়মিত মূল্য পর্যালোচনা করা: স্বর্ণের দর উঠানামা করে, তাই লাভজনক সময় দেখে বিক্রি করা উচিত।
স্বর্ণের দাম ওঠানামার কারণ কী?
স্বর্ণের দাম প্রতিদিন পরিবর্তিত হয় এবং এটি বিভিন্ন বৈশ্বিক ও দেশীয় অর্থনৈতিক বিষয়ের উপর নির্ভর করে। সাধারণত, আন্তর্জাতিক বাজার, মুদ্রার বিনিময় হার, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদার ওঠানামা স্বর্ণের দামের পরিবর্তনের প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করে। নিচে স্বর্ণের দাম কম-বেশি হওয়ার প্রধান কারণগুলো আলোচনা করা হলো।
আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব
স্বর্ণের মূল্য মূলত আন্তর্জাতিক বাজারের উপর নির্ভরশীল। বৈশ্বিক চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্যের পরিবর্তন স্বর্ণের দামের ওঠানামা ঘটায়। উদাহরণস্বরূপ:
- যদি আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের চাহিদা বৃদ্ধি পায়, তাহলে দাম বৃদ্ধি পায়।
- অন্যদিকে, সরবরাহ বেশি থাকলে দাম কমে যেতে পারে।
মুদ্রার বিনিময় হার পরিবর্তন
স্বর্ণের মূল্য সাধারণত মার্কিন ডলারে নির্ধারিত হয়। তাই ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পেলে স্বর্ণের দাম কমতে পারে, এবং ডলার দুর্বল হলে স্বর্ণের দাম বেড়ে যায়।
উদাহরণ:
- ডলারের মান বাড়লে বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম বেড়ে যায়, কারণ আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পায়।
- বিপরীতে, ডলারের মান কমলে স্বর্ণের দাম কমে যেতে পারে।
অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও বিশ্ব পরিস্থিতি
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, রাজনৈতিক সংকট, এবং ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা স্বর্ণের দামের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। স্বর্ণকে “নিরাপদ বিনিয়োগ” হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাই অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময় স্বর্ণের চাহিদা বাড়ে এবং দাম বৃদ্ধি পায়।
উদাহরণ:
- মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পেলে মানুষ বিনিয়োগের জন্য স্বর্ণ কেনে, ফলে দাম বাড়ে।
- অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরলে স্বর্ণের দাম কমতে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বর্ণ মজুদ
বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন বেশি পরিমাণ স্বর্ণ কেনে বা বিক্রি করে, তখন বাজারে স্বর্ণের মূল্য পরিবর্তিত হয়।
যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বর্ণ কিনতে শুরু করে:
- দাম বৃদ্ধি পেতে পারে।
যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বর্ণ বিক্রি করে:
- সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় দাম কমে যেতে পারে।
স্বর্ণের চাহিদা ও সরবরাহ
বিশ্বব্যাপী এবং দেশীয় পর্যায়ে স্বর্ণের চাহিদা ও সরবরাহের উপর ভিত্তি করে এর মূল্য কমবেশি হতে পারে।
চাহিদা বাড়ে যখন:
- উৎসব, বিয়ের মৌসুম, এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে স্বর্ণের চাহিদা বাড়ে।
- দাম তখন বেড়ে যেতে পারে।
সরবরাহ কমে গেলে:
- খনি থেকে স্বর্ণ উত্তোলন কম হলে দাম বেড়ে যায়।
আমদানি শুল্ক ও সরকারী নীতিমালা
বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম নির্ধারণে আমদানি শুল্ক এবং সরকারের নীতিমালা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যদি সরকার শুল্ক বাড়ায়, তবে স্বর্ণের দামও বেড়ে যায়।
উদাহরণ:
- শুল্ক হার বৃদ্ধি পেলে গয়নার দামও বৃদ্ধি পায়।
- শুল্ক কমানো হলে দাম কমে যেতে পারে।
স্বর্ণের দাম কম-বেশি হওয়ার প্রধান কারণ আন্তর্জাতিক বাজার, মুদ্রার বিনিময় হার, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি, স্থানীয় চাহিদা ও সরবরাহ, এবং সরকারের শুল্ক নীতির উপর নির্ভরশীল। স্বর্ণের বিনিয়োগ বা কেনার সময় এসব কারণ বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ।
উপসংহার
বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। তাই স্বর্ণ কেনার আগে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাকে বর্তমান স্বর্ণের দাম এবং এর সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলো সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দিয়েছে।
স্বর্ণ সম্পর্কিত সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (FAQs)
স্বর্ণের দাম কীভাবে নির্ধারিত হয়?
স্বর্ণের দাম আন্তর্জাতিক বাজার, মুদ্রার বিনিময় হার, আমদানি শুল্ক, স্থানীয় চাহিদা ও সরবরাহ, এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়।
২৪ ক্যারেট স্বর্ণ কি অলংকার তৈরিতে ব্যবহার করা হয়?
না, ২৪ ক্যারেট স্বর্ণ খুব নরম হওয়ার কারণে এটি অলংকার তৈরিতে সাধারণত ব্যবহার করা হয় না। ২২ ক্যারেট বা ১৮ ক্যারেট স্বর্ণ অলংকার তৈরিতে বেশি ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশে কোন ধরণের স্বর্ণ বেশি জনপ্রিয়?
বাংলাদেশে ২২ ক্যারেট স্বর্ণ সবচেয়ে জনপ্রিয়, কারণ এটি যথেষ্ট মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী।
বিয়ের গয়না কেনার সময় কী খেয়াল রাখা উচিত?
বিয়ের গয়না কেনার সময় বিশুদ্ধতা, ডিজাইন, ওজন, এবং স্বর্ণের দাম সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নেওয়া উচিত।